

মহিবউল্লাহ কিরন, বরগুনা জেলা প্রতিনিধিঃ
প্রিয় আমতলীবাসী,
৬/৫/২৫ এটাই হয়তো আপনাদেরকে সম্বোধন করে এই অফিসিয়াল (উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমতলী) আইডি থেকে আমার হাতে লেখা শেষ স্ট্যাটাস।
আজ থেকে হয়তো আর দেখা হবে না উপজেলা প্রশাসন লেখা অস্বচ্ছ কাঁচের দরজার ওপারে চেয়ারটিতে বসে, কালো গাড়ির গ্লাস নামিয়ে হয়তো শুনতে পারবো না আপনাদের কথা। উপজেলা পরিষদ মসজিদে নামাজের আগে বা পরে শোনা হবে না আপনাদের চাওয়া-না পাওয়ার গল্প। অফিস থেকে ফিরে বাসভবন ‘পায়রা’র সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো গল্প করা হবে না আর অফিসারদের সাথে।
সময় যে কতো দ্রুত বয়ে যায় তা বিদায়ের মুহূর্তে আরও গভীরভাবে অনুভব করছি। প্রায় দুই বছর পাঁচ মাস আপনাদের সেবায় নিয়োজিত থাকার পর আজ প্রিয় আমতলী থেকে বিদায় নিচ্ছি।
এই জনপদের প্রতি ইঞ্চি মাটি, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কান্না, সবকিছুই আমার হৃদয়ের গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। এই সময়ের প্রতিটি দিন আমার কাছে শুধুই সরকারি দায়িত্ব পালন নয়, বরং শেখার, উপলব্ধির, ভালোবাসার এবং আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পথ নিরবচ্ছিন্নভাবে কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব পালনের পথচলায় ছিলো চ্যালেঞ্জ, ছিল কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর গল্প।
যেকোনো দুর্যোগে, বিপর্যয়ে, সংকটে আমরা একসাথে কাজ করেছি সকলের জান-মালের হেফাজতে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে যখন এ জনপদের মানুষ কষ্টে, শঙ্কায় দিন কাটিয়েছে, তখন আপনাদের সাথে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।
আইনশৃঙ্খলা কিংবা জনস্বার্থ রক্ষায় অনেক সময় কঠোর হতে হয়েছে। অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে কখনো উচ্ছেদ অভিযান, কখনোবা মাদকসেবীদের কারাদণ্ড, কখনো বাজারমূল্য মনিটরিং, কখনো যানজট নিরসনে বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে হানা দেয়া, কখনোবা মা ইলিশ রক্ষায় রাত-বিরাতে পায়রা নদীতে টহল, এসব কাজ করতে গিয়ে কখনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও পিছপা হইনি। কারণ সবকিছুর একমাত্র লক্ষ্য ছিলো মানুষের কল্যাণ, যার মাধ্যমে অর্জিত হয় মহামহিম রবের সন্তুষ্টি।
সুদূর টেপুরা, কলাগাছিয়া কিংবা শাখারিয়া থেকে এসে একজন বৃদ্ধ নাগরিক যখন উপজেলা প্রশাসন লেখা অস্বচ্ছ কাঁচের দরজা পেরিয়ে সালাম দিতো, সালামের উত্তর দেয়ার পর কি কাজে এসেছেন জানতে চাইলে যখন বলতো স্যার আপনাকে একবার দেখতে এসেছি, তখন মনে হতো নি:স্বার্থ এই মানুষগুলোর ভালোবাসার জন্য দিনরাত কাজ করে যাই।
এই দুই বছর পাঁচ মাসের প্রতিটি মুহূর্তে আমি মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে চেষ্টা করেছি। আপনাদের হাসি-কান্না, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, সংগ্রাম-স্বস্তি, সবকিছুই অনুভব করেছি গভীরভাবে। বিনিময়ে আপনাদের থেকে শতকোটিগুণ ফেরত পেয়েছি “ভালোবাসা” নামে।
বিদায়ের এই মুহূর্তে আপনাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাকে প্রতিনিয়ত আবেগাপ্লুত করছে। আমতলী আমাকে শুধু একটি দায়িত্ব দেয়নি, বরং একটি পরিবার উপহার দিয়েছে। এ জনপদের সবার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। আপনাদের ভালোবাসার বিনিময় দেয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই। শুধু জানাতে চাই আমি আমতলীতে আমার হৃদয়ের একটি অংশ রেখে যাচ্ছি।
আমার কোনো কথা বা কাজে যদি আপনাদের কষ্ট দিয়ে থাকি, নিজের অজান্তেও যদি কারো হক নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ তা’আলার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমতলীর মাটি ও মানুষের জন্য আমার অন্তরের গভীর থেকে আজীবন দু’আ থাকবে। আল্লাহ তা’আলা যেন এই জনপদের সবাইকে ভালো রাখেন, দুনিয়া-আখিরাতের সর্বোচ্চ কল্যাণ যেন সবাইকে নসিব করেন।