

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বান্দরবান জেলা শুধুমাত্র তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং এর সমৃদ্ধ ইতিহাস ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্যও বিশেষভাবে পরিচিত। পাহাড়, নদী, ঝর্ণা আর মেঘের অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত এই অঞ্চলের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বর্ণিল সংস্কৃতির ছাপ।
নামকরণের ইতিহাস:
বান্দরবান নামের উৎপত্তি নিয়ে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। কথিত আছে, একসময় এই অঞ্চলে অসংখ্য বানর দলবেঁধে লবণ খেতে আসত এবং তারা দলবদ্ধভাবে এমনভাবে চলাফেরা করত যা দেখতে অনেকটা বাঁধ বা ‘বান’ দেওয়ার মতো মনে হতো। এই “বানরের বাঁধ” থেকেই কালক্রমে “বান্দরবান” নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। স্থানীয় মারমা ভাষায় এর নাম ‘রদ ক্য চিং ম্রো’।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
- প্রাচীনকাল ও আরাকানি প্রভাব:
বান্দরবানের প্রাচীন ইতিহাস অনেকটা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই আরাকানি ও চাকমা রাজাদের শাসন এবং ত্রিপুরা রাজ্যের প্রভাবের সাথে জড়িত। বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চল আরাকানি রাজ্যের অধীনে ছিল। এখানকার মারমা জনগোষ্ঠী আরাকান থেকে আগত বলে মনে করা হয়। - মোগল ও ব্রিটিশ আমল:
মোগল আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সরাসরি তাদের শাসনাধীন না থাকলেও এর কিছু অংশ করদ রাজ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক জেলা হিসেবে গঠন করে। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এই জেলাকে পরবর্তীতে তিনটি সার্কেলে (চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মং সার্কেল) ভাগ করা হয়। বান্দরবান জেলা মূলত বোমাং সার্কেলের অধীনে পড়ে। - বোমাং সার্কেল ও রাজ প্রথা:
বান্দরবানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী দিক হলো বোমাং রাজবংশ। বোমাং রাজারা বংশপরম্পরায় এই অঞ্চলের মারমা ও অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। বোমাং রাজবাড়ি বান্দরবান শহরের একটি অন্যতম আকর্ষণ। প্রতি বছর রাজপুণ্যাহ উৎসব (পইংজ্রা পোয়ে) অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রজারা রাজাকে বার্ষিক খাজনা বা নজরানা প্রদান করে এবং রাজা তাদের আশীর্বাদ করেন। এটি একটি বর্ণাঢ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। - স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বান্দরবান একটি মহকুমা হিসেবে ছিল। ১৯৮১ সালে এটি জেলা হিসেবে উন্নীত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির (১৯৯৭) পর এই অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য:
বান্দরবানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এখানে প্রায় ১১টিরও বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও উৎসব।
- বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী:
- মারমা:বান্দরবানের সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের ভাষা, পোশাক (থামি, ব্লাউজ) ও সংস্কৃতি খুবই আকর্ষণীয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মারমারা সাংগ্রাই উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে পালন করে।
- ম্রো (মুরুং):পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীনতম জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম। তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘ওয়াংলাই’ এবং মাথায় পাখির পালক ব্যবহারের জন্য পরিচিত। তাদের নিজস্ব ধর্ম ‘ক্রামা’ এবং বিভিন্ন লোকউৎসব রয়েছে।
- ত্রিপুরা:তাদের নিজস্ব ভাষা ‘ককবরক’ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি রয়েছে। বৈসুক বা বৈসু উৎসব তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠান।
- তঞ্চঙ্গ্যা:চাকমাদের সাথে এদের অনেক মিল থাকলেও নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা রয়েছে।
- বম:মূলত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। তাদের পোশাক ও জীবনযাত্রা ভিন্ন ধরনের।
- চাকমা:বান্দরবানে সংখ্যায় কম হলেও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিদ্যমান।
- এছাড়াওলুসাই, খিয়াং, চাক, খুমি, পাংখোয়া, সাঁওতাল, ওরাওঁসহআরওকিছুক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীরবসবাসরয়েছে।
- ভাষা ও সংস্কৃতি:
প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা বা উপভাষা রয়েছে। তবে যোগাযোগের জন্য অনেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে। তাদের গান, নাচ, লোককথা ও কিংবদন্তীগুলো এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। - পোশাক–পরিচ্ছদ:
আদিবাসী নারীদের প্রধান পোশাক হলো ‘পিনন’ (কোমরে পরার বস্ত্র) ও ‘হাদি’ (বক্ষবন্ধনী)। মারমা নারীরা ‘থামি’ ও ব্লাউজ পরে। পুরুষরা সাধারণত লুঙ্গি বা শার্ট-প্যান্ট পরিধান করে, তবে উৎসবের সময় ঐতিহ্যবাহী পোশাকও দেখা যায়। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পোশাকে বুনন ও নকশার বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। - খাদ্যাভ্যাস:
আদিবাসীদের খাদ্যাভ্যাসও স্বতন্ত্র। বাঁশ কোঁড়ল (ব্যাম্বু শুট), নাপ্পি (এক ধরনের শুঁটকি), বুনো শাকসবজি ও ফলমূল তাদের প্রধান খাদ্য। ‘বিনি ভাত’ (এক প্রকার আঠালো চাল) এবং বিভিন্ন ধরনের পিঠা তারা তৈরি করে। জুম চাষে উৎপাদিত শস্য তাদের খাদ্যের অন্যতম উৎস। - উৎসব ও অনুষ্ঠান:
- সাংগ্রাই (মারমা):বাংলা নববর্ষের সময় মারমাদের প্রধান উৎসব। পানি খেলার (জলকেলি) মাধ্যমে তারা একে অপরের মঙ্গল কামনা করে।
- বৈসাবি (ত্রিপুরা–চাকমা–মারমা):ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমাদের ‘বিজু’ – এই তিন উৎসবের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে সম্মিলিতভাবে ‘বৈসাবি’ বলা হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব।
- ওয়াহেগ্যোয়াই (মারমা):মারমাদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব, যা প্রবারণা পূর্ণিমা নামেও পরিচিত।
- এছাড়াওবিভিন্নজনগোষ্ঠীরনিজস্বধর্মীয়ওসামাজিকউৎসবসারাবছরধরেপালিতহয়।
- ধর্ম ও বিশ্বাস:
বান্দরবানের আদিবাসীদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাই বেশি (বিশেষত মারমা ও চাকমা)। এছাড়াও খ্রিস্টান (বম, লুসাই) এবং প্রকৃতি পূজারী ও নিজস্ব লোকজ ধর্মে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীও (যেমন ম্রো) রয়েছে। - হস্তশিল্প:
আদিবাসী নারীরা তাঁতশিল্পে অত্যন্ত দক্ষ। তারা নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করে। এছাড়া বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন গৃহস্থালি ও শৌখিন সামগ্রী বান্দরবানের হস্তশিল্পের অন্যতম আকর্ষণ।
প্রাকৃতিক ঐতিহ্য:
বান্দরবানের পাহাড়, নদী (সাঙ্গু, মাতামুহুরী), ঝর্ণা (শৈলপ্রপাত, নাফাখুম, আমিয়াখুম, জাদিপাই, বাকলাই), মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরি, চিম্বুক, কেওক্রাডং, তাজিংডং (বিজয়) ইত্যাদি শুধুমাত্র দর্শনীয় স্থানই নয়, এগুলো এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। এখানকার জীববৈচিত্র্যও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গুরুত্বপূর্ণ স্থান (ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক):
- বুদ্ধ ধাতু জাদি (স্বর্ণমন্দির):বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর বৌদ্ধ মন্দির।
- রাজবাড়ি:বোমাং রাজার ঐতিহ্যবাহী বাসভবন।
- বিভিন্ন আদিবাসী গ্রাম:যেখানে তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ মেলে।
- মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স:এখানে একটি মিনি সাফারি পার্ক ও ঝুলন্ত সেতু রয়েছে।
উপসংহার:
বান্দরবান কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিই নয়, এটি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য একে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় জেলায় পরিণত করেছে। এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং এর যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।